আগেকার দিনে জাহাজ চালানোর কাজে অথবা কোন মানুষ নিজে রাস্তার দিক নির্দেশনা ব্যাবহার করতে ম্যাপ এর সাথে কম্পাস ব্যাবহার করে তার অবস্থান বের করে যাতায়াত করত।এই পদ্ধতি ছিল যেমন কষ্টকর আবার অনেকের জন্য এটা ব্যাবহার করাও ছিল অসাধ্য একটি কাজ।কিন্তু বর্তমান সময়ে আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোনের সাহায্যে আমি নিমিষেই আপনার অবস্থান জানতে পারেন এবং সে অনুসারে যাতায়াত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আর আপনার স্মার্টফোনে যে প্রযুক্তির মাধ্যমে এই কাজটি সম্পন্ন করা হয়ে থাকে সেই সিস্টেম এর নাম হল গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা সংক্ষেপে জিপিএস (GPS)।
আমরা আজকের লেখার মাধ্যমে জিপিএস সম্পর্কিত সকল তথ্য বিস্তারিত ভাবে জানার চেষ্টা করব।যেমনঃ জিপিএস কি?জিপিএস কিভাবে কাজ করে?কখন এবং কারা প্রথমে কি কাজের জন্য জিপিএস তৈরি করেছিল?এই রকম আরও অনেক তথ্য সম্পর্কে এই আর্টিকেল থেকে জানবো।তাহলে চলুন কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনা শুরু করা যাক।
জিপিএস(GPS) এর পূর্ণ রূপ কি?
জিপিএস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার আগে আমাদেরকে অবশ্যই জিপিএস এর বেসিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।কারন বেসিন ইনফর্মেশন গুলো জানলে সম্পূর্ণ আর্টিকেল বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।আর্টিকেলের শুরুতেই আমাদেরকে জানতে হবে জিপিএস এর পূর্ণ রূপ কি?জিপিএস (GPS) এর পূর্ণ রূপ হলঃ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (Global Positioning System)।
জিপিএস (GPS) কখন তৈরি করা হয়েছিলো এবং কেন তৈরি করা হয়েছিলো?
জিপিএস প্রযুক্তি প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করা হলেও পরে এই প্রযুক্তি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।এবং দেখা যায় মার্কিন সেনাবাহিনীর থেকে এই প্রযুক্তির দ্বারা সাধারণ মানুষই বেশী উপকৃত হয়েছে।জিপিএস প্রযুক্তি আবিস্কার হবার আগে যেখানে কম্পাস এবং আকাশের নক্ষত্রের মাধ্যমে দিক নির্ধারণ করা হত সেখানে জিপিএস প্রযুক্তি আসার পরে কম্পাস এবং নক্ষত্রের উপরে নির্ভরশীলতা পুরাপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়।এবং প্রথম দিকে জাহাজ এবং বিমান চালানোর কাজে জিপিএস প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হলেও পরবর্তীতে স্মার্ট ফোনের প্রচলন হলে এই প্রযুক্তি আমাদের স্মার্ট ফোনেও ব্যাবহার করা হয় যার মাধ্যমে আমার এখন খুব সহজেই মাত্র কয়েকটি ক্লিক করেই আমাদের সঠিক অবস্থান জেনে নিতে পারি।
জিপিএস (GPS) প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে মহাকাশে ঘুরতে থাকা বেশ কিছু সংখ্যক কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে জিপিএস প্রযুক্তি কাজ করে।আমরা যখন কোন স্থানে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই তখন এই স্যাটেলাইট গুলো নিজেদের মধ্য তথ্য আদান-প্রদান এবং বিশ্লেষণ করে আমাদেরকে সেই জায়গার সঠিক অবস্থান সম্পর্কে আমাদেরকে জানায়।
এখন ধরেন আপনি বান্দরবনে ঘুরতে গেছেন এবং আপ্নাই জানতে চাচ্ছেন যে আপনি কোথায় আছেন।এখন যদি আপনাকে বলা হয় যে আপনি ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে আছেন।তাহলে কিন্তু কেউ আপনার নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারল না।আবার যদি বলা হয় আপনি কুমিল্লা থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে আছেন এইবারও কিন্তু আপনার নির্দিষ্ট অবস্থান পরিস্কার নয়।কিন্তু যদি বলা হয় আপনি খাগড়াছড়ি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে আছেন তাহলে কিন্তু আপনাকে খুঁজে বের করা একদম সহজ হয়ে যাবে।
কারন উপরে বলা তিনটি জায়গার যে দুরুত্ব যে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ছেদ করবে সেইটাই হল আপনার অবস্থান।জিপিএস এর মাধ্যমে এই অবস্থা খুঁজে বের করার পদ্ধতিকে বলা হয় Trilateration (ত্রিপক্ষীয়করণ)।এই পদ্ধতিতে যেকোনো জায়গার অবস্থান নির্ণয় করার জন্য অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ এবং উচ্চতা ব্যাবহার করা হয়।
আবার উপরে আমরা যে তিনটি জায়গা থেকে যে দুরুত্বের কথা উল্লেখ করলাম এই তিনটি জায়গার দুরুত্ব যে জায়গায় মিলিত হয় সেই জায়গাকে বলা হয় সমন্বয় বিন্দু (Coordinate Point) ।এখন হয়ত আপনি ভাবতে পারেন যে আমাদের এই পৃথিবীতে একই নামের একাধিক জায়গা থাকলে তখন কি হবে?এখানে আমাদের জন্য হেল্প করে Coordinate Point বা সমন্বয় বিন্দু।কারন পৃথিবীর যেকোনো দুইটি জায়গার নাম এক হলেও এদের Coordinate Point বা সমন্বয় বিন্দু কখনয় এক হবে না।ফলে নাম এক হলেও Coordinate Point বা সমন্বয় বিন্দু পদ্ধতি ব্যাবহার করে জিপিএস আপনার সঠিক এবং নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে।
জিপিএস কে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়?
উপরের আলোচনায় আমরা জানলাম জিপিএস কিভাবে কাজ করে এখন আমরা জানব জিপিএস কে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয় সেই সম্পর্কে।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে,আমাদের সারা পৃথিবীর প্রতিটি জায়গাকে জিপিএস ব্যাবস্থার অধীনে নিয়ে আসার জন্য সর্বক্ষণ ৩০ টি স্যাটেলাইট কাজ করছে।তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমগ্র পৃথিবীকে জিপিএস (GPS) ব্যাবস্থার অধীনে নিয়ে আসার জন্য আমাদের ২৪ টি স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হয়।তাহলে অতিরিক্ত ৬ টি স্যাটেলাইট কেন রাখা হয়েছে?অতিরিক্ত ৬ টি স্যাটেলাইট বেশী রাখার মূল কারন হল কখনও যদি ২৪ টি স্যাটেলাইটের কোন একটি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় তাহলে অতিরিক্ত ৬ টি থেকে যেকোনো একটি যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়া স্যাটেলাইটের জায়গায় কাজ করবে।এবং এর ফলে আমাদের জিপিএস ব্যাবস্থা কখনো বিঘ্নিত হবেনা।
জিপিএস সেবার জন্য পৃথিবী থেকে উপরে একটি নির্দিষ্ট দুরুত্বে স্যাটেলাইট গুলো (২৪ টি) এমন ভাবে বসানো হয়েছে যে যেকোনো মানুষ (মূলত যেকোনো জিপিএস ডিভাইস) সব সময় ৪ টি স্যাটেলাইটের আওতায় থাকে।
জিপিএস (GPS) স্যাটেলাইট গুলো মহাকাশের কোথায় অবস্থান করে এবং সারাক্ষণ কি কাজ করে?
আমাদের যে স্যাটেলাইট গুলো জিপিএস সেবা প্রদান করে থাকে সেই স্যাটেলাইট গুলো আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার উপরে আমাদের এই পৃথিবীকে কেন্দ করে ঘুরতে থাকে এবং এরা পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় প্রায় ১২ ঘণ্টা এবং একদিনে দুইবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
এই জিপিএস স্যাটেলাইট গুলো যখন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে তখন এরা প্রতি মুহূর্তে রেডিও সিগন্যাল আমাদের পৃথিবীতে পাঠাতে থাকে এবং সেই সিগন্যাল আমাদের হাতে থাকা বিভিন্ন জিপিএস চিপস বা জিপিএস সেন্সর গ্রহন করতে থাকে।আর এই সিগন্যাল গ্রহন করার ফলেই আমরা আমাদের রিয়েল টাইম অবস্থান জানতে পারি।
জিপিএস (GPS) এর মাধ্যমে কিভাবে আমাদের অবস্থান নির্ণয় করা হয়?
আমাদের হাতে থাকা জিপিএস চিপসের মাধ্যমে কিভাবে আমাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা হয় সেটা জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে কিভাবে জিপিএস ডিভাইসে সিগন্যাল গ্রহন করা হয়।যখন স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল পাঠানো হয় এবং আমাদের হাতে থাকা জিপিএস ডিভাইস সেই সিগন্যাল গ্রহন করে তখন সেটি দুইটি সময়ের রেকর্ড করে থাকে।এর মধ্য একটি সিগন্যাল পাঠানোর সময় এবং একটি সিগন্যাল গ্রহনের সময়।
সিগন্যাল পাঠানো এবং রিসিভার ডিভাইসে সিগন্যাল গ্রহনের মধ্যবর্তী সময়ের যে ব্যাবধান সেই সময়ের ব্যাবধানের মাধ্যমেই দুরত্ব নির্ণয় করে আপনার আমার সঠিক অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হয়।স্যাটেলাইট থেকে যে রেডিও সিগন্যাল পাঠানো হয় সেই সিগন্যাল গুলো এক সেকেন্ড কে এক লক্ষ ভাগ করে যে এক ভাগ পাওয়া যায় সেই সময়ের মধ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরুত্ব অতিক্রম করে থাকে।
অর্থাৎ,স্যাটেলাইট থেকে আমদের হাতে থাকে জিপিএস ডিভাইসে রেডিও সিগন্যাল পৌঁছাতে ১ সেকেন্ডেরও কম সময়ের প্রয়োজন হয়।আর এই অতি খুদ্র সময় পরিমাপ করা হয়ে থাকে এটমিক ক্লক বা আণবিক ঘড়ির মাধ্যমে।স্যাটেলাইট থেকে পৃথিবীতে থাকা কোন জিপিএস চিপস বা সেন্সরে সিগন্যাল পৌঁছাতে যে সময় লাগে তার সাথে তিন গুন করে আমাদেরকে যেকোনো জায়গার দুরুত্ব দেখানো হয়ে থাকে।
জিপিএস সেবা এই পৃথিবী থেকে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়?
জিপিএস সেবা যেন কখনো বিঘ্নিত না হয় সেই কারনে এই জিপিএস সেবার সাথে যুক্ত স্যাটেলাইট গুলো দেখাশোনার জন্য সারা পৃথিবী ব্যাপী ৩০ টি নিয়ন্ত্রন কক্ষ রয়েছে।প্রথম দিকে মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য এই সেবা তৈরি করা হলেও পরিবর্তীতে এই সেবা সর্ব সাধারনের কল্যাণের কথা চিন্তা করে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।বর্তমানে জিপিএস সেবা বিমান বা জাহাজ হারিয়ে গেলে এবং বিভিন্ন ধরনের লোকেশন সেবার জন্যই ব্যাবহার করা হয়ে থাকে।এছারা ১৯৯৬ সাল থেকে মোটরগাড়িতেও জিপিএস সেবা ব্যাবহার করা শুরু করা হয় এর ফলে গাড়ীর মালিকেরা এবং এসব গাড়ীর সেবা গ্রহণকারী ব্যাক্তিরাও রিয়েল টাইম পজিশন জানার সুযোগ পাচ্ছে।
শেষ কথা
আমাদের এটা মানতেই হবে যে জিপিএস আমাদের জন্য প্রযুক্তির একটি অনন্য আশীর্বাদ।জিপিএস সেবার মাধ্যমে আমরা আমাদের যানবাহন এবং আমাদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমাদের রিয়েল টাইম অবস্থান জানতে পারি এবং কোন বিমান অথবা জাহাজ হারিয়ে গেলে সেইগুলোকে আমারা জিপিএস সেবা ব্যাবহার করে খুঁজে বের করতে পারি এবং আমরা যদি কখনো হারিয়ে যাই এবং আমাদের হাতে কোন জিপিএস চিপস অথবা সেন্সর যুক্ত ডিভাইস থাকে তাহলে আমরা খুব সহজেই আমাদের সঠিক অবস্থান উদ্ধারকারীদের জানাতে পারি।