সর্বশেষ সংবাদ

ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে ৩৭ যুবককে জিম্মি

দালাল ধরে ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় আটকে আছেন চুয়াডাঙ্গার ৩৭ যুবক। দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায় করলেও তাদের ছাড়েনি লিবিয়ার মাফিয়ারা। বরং তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানবিক নির্যাতন। ভিডিও কলের মাধ্যমে সেই নির্যাতনের চিত্র দেখানো হচ্ছে স্বজনদের। ফের দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। সহায় সম্বল হারিয়ে নিরুপায় পরিবারগুলো। প্রাণে বেঁচে ফেরানোর আকুতি তাদের।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় চুয়াডাঙ্গার খেজুরতলা ও বেলগাছি গ্রামের ভুক্তভোগী ২২ পরিবার চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সময় পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের লিবিয়ায় আটকে রেখে ওপর নির্যাতন ও জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনার বর্ণনা করেন।

পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচিয়ে সচ্ছলতা ফেরাতে ইউরোপের দেশ ইতালিতে যেতে চেয়েছিলেন আলমডাঙ্গার ৩৭ যুবক। স্থানীয় দালালদের প্রতারণার জালে প্রথমে জনপ্রতি ১৩ লাখ টাকা করে দিয়ে দেশ ছাড়েন তারা। দফায় দফায় গুনতে হয়েছে আরও ১০-১৫ লাখ টাকা। তবুও মেলেনি বেঁচে ফেরার নিশ্চয়তা। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে বন্দীদের বাঁচানোর আকুতি পরিবারগুলোর। গ্রামে গ্রামে রোল পড়েছে কান্নার।

কথা ছিল, দুবাই হয়ে নিয়ে যাওয়া হবে স্বপ্নের দেশ ইতালিতে। কিন্তু তাদের নেওয়া হয় লিবিয়ায়। জিম্মি হয় মাফিয়া চক্রের হাতে। টানা ১১ মাস ধরে লিবিয়ায় বন্দী ওই যুবকেরা। দফায় দফায় মুক্তিপণ দিলেও মুক্তি পাননি তারা। বরং আরও মুক্তিপণ চাচ্ছে চক্রটি। চালানো হচ্ছে নির্যাতন।

আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের ভুক্তভোগী মো. জুয়েল। স্ত্রী পলি খাতুন সংবাদ সম্মেলনে জানান, বেলগাছি গ্রামের জান্টু মেম্বারের ছেলে সাগর দালাল লিবিয়ায় প্রবাসে থাকা তাঁর দেবরের পরিচিত হওয়ায় বিশ্বাস অর্জন করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাগর তাঁর স্বামীকে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে ভালো কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে। পরে তাদের ১৩ লাখ টাকায় চুক্তি হয়, যার মধ্যে ১০ লাখ টাকা আগেই দেওয়া হয়। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে। পরে জীবন বাঁচাতে পরিবার থেকে টাকা পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ‘এখন তাঁরা আমার স্বামীকে আটকে রেখে আরও অর্থ দাবি করছে।’

একই গ্রামের মিঠু মিয়াও জিম্মি। তাঁর পিতা তামছের আলী বলেন, ‘বেলগাছি গ্রামের জীমের মাধ্যমে ছেলে মিঠুকে ইতালি পাঠানোর জন্য জমি বিক্রিসহ ১৩ লাখ টাকা দেই। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করে। ছেলের জীবন বাঁচাতে তা-ও দেই। এখন আবার ২০ লাখ টাকা চাচ্ছে, না দিলে ছেলেকে বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।’

অপর ভুক্তভোগী আব্দুল্লাহ জাহির দীপু। তাঁর বোন সাবিনা খাতুন বলেন, ‘প্রথমে বলা হয়েছিল এক মাসের মধ্যে ইতালি পৌঁছে দেওয়া হবে। ঢাকা এয়ারপোর্টে জীমের হাতে ৩ লাখ টাকা দিই। দুবাই পৌঁছানোর পর আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে। পরে আরও ৭ লাখ টাকা তাদের বাড়িতে গিয়ে দিই। এখন তাঁরা ভাইকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে, ভিডিও কলে অত্যাচারের ভিডিও দেখিয়ে আরও টাকা দাবি করছে। টাকা না দিলে নির্যাতন আরও বেশি করছে।’

জিম্মি তুহিন মিয়ার (১৯) পিতা রেজাউল হক বলেন, ‘সাগর ও জীমের মাধ্যমে আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। শুরুতে ১০ লাখ টাকা এবং পরে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু লিবিয়ায় নিয়ে আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ছেলের ওপর অত্যাচারের হুমকি দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি, পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। মুক্তিপণের টাকা কোথা থেকে দেব বুঝে পাচ্ছি না।’ রেজাউল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগী সবাই এক হয়ে থানায় মামলা করেছি। কিন্তু পুলিশ কাউকে আটক করছে না।’

গতকাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা এবং আটকে পড়া স্বজনদের মুক্তির জন্য চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ, প্রশাসন ও সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। এ ঘটনায় আলমডাঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। শুরু হয়েছে আইনগত পদক্ষেপ।

এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মিলিত একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। থানা-পুলিশের সদস্যরা একাধিক অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু আসামিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। তবে, যেহেতু ঘটনাটি দেশের বাইরের এ জন্য মামলাটি সিআইডি পুলিশে স্থানান্তর করা হকে পারে। আমরা আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে।’

সোর্স: ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *