সর্বশেষ সংবাদ

বাশারের ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত ১৩৭০০০ বন্দি যা বলল

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর রাজধানী দামেস্ক বিদ্রোহীদের দখলে। বিদ্রোহীরা দেশটির কুখ্যাত সায়দনায়া কারাগারের তালা খুলে দিয়েছেন। ভূগর্ভস্থ সায়দনায়া কারাগার থেকে বেঁচে ফিরেছে লক্ষাধিক মানুষ।

সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের বরাতে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানাচ্ছে, সায়দনায়া কারাগারে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জনের বেশি কারাবন্দিকে রাখা হয়েছিল।যাদের বিদ্রোহীরা মুক্ত করে দিয়েছেন।

সিরিয়ার কারাগারগুলো আল-আসাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। ২০১৩ সালে কারাগারের কিছু ছবি প্রকাশ করে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, সিরিয়ার কারাগারে আটকদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদেরকে মারধর করা হচ্ছে, খাবার দেওয়া হচ্ছে না; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

মাত্র ১২ দিনে দামেস্কের দখল নিয়ে নেয় বিদ্রোহীরা। গত ২৭ নভেম্বর নতুন করে আক্রমণ শুরু করার পর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা এগিয়েছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। চার দিনের মাথায় একরকম প্রতিরোধ ছাড়াই তারা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী আলেপ্পো দখলে নেন।

গতকাল রবিবার বিদ্রোহীদের কাছে নতি স্বীকার করে বাশার আল-আসাদের দেশ ছাড়েন।এর আগে ও পরে হাজার হাজার কারাবন্দি মুক্তি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে হালা অন্যতম।

এই নারী আলজাজিরাকে বলেন, ২০১৯ সালে হামা শহরের একটি চেকপোস্ট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়। আসাদবিরোধীদের ওপর এমন অভিযোগ হরহামেশাই তোলা হয়েছে।

এরপর হালাকে আলেপ্পোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার বিভিন্ন কারাগারে ছিলেন হালা।

 

হালা জানান, বিরোধীরা ২৯ নভেম্বর আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। তখন তাকে এবং আরো অগণিত বন্দিকে মুক্ত করে দেন তারা।

হালা একজন মেয়েকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের কথা স্মরণ করেন। ১৬ বছর বয়সী ওই মেয়েটি শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। বিয়ের মাত্র দুই মাস পরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। হালা বলেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, এক বৃদ্ধা ও দুজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের চিকিৎসা করার অভিযোগ এনেছিল পুলিশ।’

আলেপ্পোর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়াদের একজন সাফি আল-ইয়াসিন। ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তির মতে, যেন তার নতুন করে জন্ম হলো। এই মুক্তির স্বাদ তার কাছে বর্ণনা করার মতো নয়।

আলজাজিরাকে ইয়াসিন জানান, ২৯ নভেম্বরের আগে কারাগারের কাছাকাছি যুদ্ধের শব্দ শুনেছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘নীরবতা শেষে আমরা বিজয়ধ্বনি শুনেছি।’

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেকজন মাহের। ভয়ে এখনো নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে চান না তিনি​। ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিনা বিচারে সাত বছর কারাগারে রাখা হয় তাকে।

মাহের বলেন, ‘প্রতিটি মিনিট মৃত্যুর কাছাকাছি ছিলাম, নির্যাতনের তীব্রতা ও নির্মমতা কোনো পশুও সহ্য করতে পারবে না।’

মাহের একটি অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন। তিনি জানান, বন্দি থাকাকালীন দামেস্কের কুখ্যাত মেজ্জেহ কারাগারে এক আত্মীয়ের দেখা পান তিনি।

মেহের বলেন, ‘কারাগারের বাইরে হঠাৎ একটি বাস এলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন বন্দিকে আমার সেলে পাঠান হয়। তাদের মধ্যে একজনকে আমার ভগ্নিপতির মতো মনে হচ্ছিল। আমি প্রথমে দ্বিধান্বিত ছিলাম। ভাবছিলাম, এটা তো আয়মান (মাহেরের ভগ্নিপতি) হতে পারে না, সে তো পা হারায়নি!’

মাহের সন্দেহ দূর করতে সেই বন্দির কাছে যান এবং দেখেন তার ভগ্নিপতি পা হারানোর পাশাপাশি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছেন।

বার্তা সংস্থা এএফপির যাচাইকৃত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সায়দনায়া কারাগার থেকে যারা মুক্তি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনকে খুঁজতে সিরিয়ানরা ছুটে আসছেন।

বিবিসি জানিয়েছে, ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের সময় সরকারি বাহিনী লাখ লাখ মানুষকে আটক করে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বলেছে, তারা হোমস সামরিক কারাগার থেকে তিন হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্ত করেছে। সায়দনায়া কারাগারে অত্যাচার যুগের সমাপ্তি ঘোষণাও করেছেন বিদ্রোহীরা।

২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে অ্যাসোসিয়েশন অব ডিটেইনিজ অ্যান্ড মিসিং সেডনায়া প্রিজন (এডিএমএসপি) বলেছিল, ‘গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাইদনায়া কার্যকরভাবে একটি মৃত্যুশিবিরে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নির্যাতন, চিকিৎসা সেবার অভাব বা অনাহারে ৩০ হাজারের বেশি বন্দির মৃত্যু হয়েছে বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দির হিসেবে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কমপক্ষে আরো ৫০০ বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে এডিএমএসপি সায়দনায়াকে ‘মানব কসাইখানা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

অ্যামনেস্টির একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছিল, আসাদ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। সেই সময়ে সরকার অ্যামনেস্টির দাবিগুলোকে ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘সত্যবর্জিত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল আসাদ সরকার।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *