নিউমার্কেট এলাকা রণক্ষেত্র!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রবিবার রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নীলক্ষেত মোড়ে হওয়া সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ সাতজন আহত হয়েছেন। লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার পাশাপাশি ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এ সময় আশপাশের এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

এক পর্যায়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। গত রাত আড়াইটা পর্যন্ত দফায় দফায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে কয়েক শ পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এসে তোপের মুখে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি, পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া ঢাবি শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর হামলা করেছেন। এ ঘটনায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা।

এর আগে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনরত সাত কলেজের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে রাখেন। এরপর নীলক্ষেত মোড়, এলিফ্যান্ট রোডসহ পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারও অবরোধ করেন তাঁরা। এতে এসব সড়ক ও আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, সাত কলেজের সমস্যা ও ভর্তির আসনসংখ্যা কমানোর বিষয়ে গতকাল বিকেলে ঢাবির উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) কাছে গেলে তিনি অশোভন আচরণ করে কক্ষ থেকে বের করে দেন এবং বলেন, সাত কলেজের বিষয়ে কিছু জানেন না। এরপর সড়ক ছেড়ে রাত ১১টার দিকে তাঁরা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে অবস্থান নেন।

এ সময় ইডেন কলেজের ছাত্রীরা তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন।
এক পর্যায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের ধাওয়া দেন। এ সময় নীলক্ষেত মোড় থেকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পিছু হটেন। পরে তাঁরা আবার এক জোট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পাল্টাপাল্টি এই ধাওয়ার মধ্যে রাত ১২টার পর পুলিশ মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর পরও দুই পক্ষের শিক্ষার্থীরা দুই দিকে অবস্থান নিয়ে উত্তেজনা ছড়ান।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অপমান করেন। এর প্রতিবাদে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেন। তাঁদের পাঁচ দফা দাবি মেনে নিতে হবে এবং উপ-উপাচার্যকে তাঁর আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ রাকিব জানান, দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। আজ (রবিবার) তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুনের সঙ্গে দেখা করে দাবিগুলোর কথা জানালে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বলেন, ‘তোমরা কারা?’ এটি শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত। তাই তাঁরা সেখান থেকে বের হয়ে এসে সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সঙ্গে কথা বলতে তারা এসেছিল। আমি তখন তাদের বলেছি, তোমরা সবাই না এসে দুজন আসো। তবে ধাক্কাধাক্কি করে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ভেতরে ঢুকে যায়। এর বাইরে সেখানে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি।’

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা বিষয়ে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সাত কলেজের বিষয়ে যে কমিটি আছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।

তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, এ বিষয়ে ২১ দিন আগে তাঁকে স্মারকলিপি দেওয়া হলেও সেটি পড়েননি। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের চেনেন না বলেই তিনি আক্রমণাত্মক ব্যবহার করেছেন। তাই তাঁর অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আব্দুর রহমান অশোভন আচরণের জন্য ঢাবির উপ-উপাচার্যকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে পাঁচ দফা দাবির কথা জানান।

শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি হলো—২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে; সাত কলেজের শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না; শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে; সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় নেগেটিভ মার্ক যুক্ত করতে হবে; সাত কলেজের ভর্তি ফিয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাবি ছাড়া নতুন একটি অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফির টাকা জমা রাখতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অধ্যক্ষদের এক জরুরি সভা সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় উপাচার্য কার্যালয়সংলগ্ন সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। সভায় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে গাবতলী থেকে কল্যাণপুর, শ্যামলীসহ পুরো মিরপুর রোডে ব্যাপক যানজটে আটকে পড়ে মানুষ। সড়ক অবরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের (ধানমণ্ডি জোন) সহকারী কমিশনার রাজীব গাইন বলেন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় আটকে রেখে প্রথমে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্ররা। এরপর একই কলেজের আরেকটি অংশ অবস্থান নেয় শাহবাগ মোড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এসব জায়গায় ছাত্ররা অবরোধ শুরু করেন। রাত ১০টা পর্যন্ত সড়কে এর প্রভাব পড়ে।

এ বিষয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সহকারী কমিশনার বিমল চন্দ্র বর্মণ বলেন, সন্ধ্যার পর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা টেকনিক্যাল মোড় অবরোধ করেন। তবে মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য তাঁরা অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু সময় পর আবারও সড়কে বসে পড়েন।

সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের ‘ফোকাল পার্সন’ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, ‘সাত কলেজকে স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।’

এর আগে রাত ১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত এবং ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। তাঁদের মাঝখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সেখানে উপস্থিত হন। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি।

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ। এক ভিডিও বার্তায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার আলোচনাকে কেন্দ্র করে রাতে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, তা দুঃখজনক। এতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু পরিবেশে পারস্পরিক আলোচনা মাধ্যমে এই ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের মধ্যে যে উত্তেজনার সূত্রপাত হয়েছিল, তা প্রশমিত করার জন্য দু-পক্ষকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানাই।’

সূত্র: কালের কণ্ঠ